জনসংখ্যায় সবচেয়ে বড় ১০টি ইহুদি দেশ

বিশ্বজুড়ে প্রায় ১ কোটি ৬১ লক্ষ অনুসারী নিয়ে ইহুদি ধর্ম বিশ্বের অন্যতম একটি আব্রাহামিক ধর্ম। এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মগুলোর একটি। ইতিহাসে এই ধর্মকে ঘিরে রয়েছে নানা শোষণ ও নিপীড়নের ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গঠিত হয় ইসরায়েল দেশ। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই দেশটি বারবার আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে এসেছে দেশটির সাথে ফিলিস্তিন মুসলিমদের যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে। বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.২% মানুষ ইহুদি ধর্মের অনুসারী যার অধিকাংশই ইসরায়েলে বসবাস করে।  The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাব জনসংখ্যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি ইহুদি দেশ সম্পর্কে।

১০. জার্মানি 

ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত বিশ্বের দশম বৃহত্তম ইহুদি দেশ জার্মানি। দেশটির মোট জনসংখ্যা ৮ কোটির বেশি যেখানে প্রায় ১ লক্ষ ১৮ হাজার জন ইহুদি ধর্মাবলম্বী। জার্মানিতে ইহুদিদের একটি দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস রয়েছে। খ্রিস্টীয় যুগের শুরু থেকেই ইহুদিরা জার্মানি ও তার আশেপাশের অঞ্চলে বাস করে আসছে এবং মধ্যযুগে জার্মানির শহরগুলোতে ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। একই সাথে তারা দেশটির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে মিশে যায়। তবে জার্মানিতে ইহুদিদের সবচেয়ে ভয়াবহ সময় পার করতে হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনী প্রায় ছয় মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করে যা বিশ্ব ইতিহাসের এক বর্বরোচিত অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জার্মানিতে ইহুদিদের অবস্থার উন্নতি হলেও ইহুদি বিদ্বেষ আজও জার্মানির একটি গুরুতর সমস্যা। 

৯. অস্ট্রেলিয়া 

অস্ট্রেলিয়া একটি ধর্মীয়ভাবে বৈচিত্র্যময় দেশ যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ইহুদিরা। দেশটির প্রায় ২ কোটির অধিক জনসংখ্যার মধ্যে ১ লক্ষ ১৮ হাজার জন ইহুদি যা অস্ট্রেলিয়াকে জনসংখ্যায় বিশ্বের নবম বৃহত্তম ইহুদি দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় সর্বপ্রথম ১৭৮৮ সালে ইহুদিদের আগমন ঘটে। এরা ছিল মূলত ব্যবসায়ী যারা অস্ট্রেলিয়ার ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে অস্ট্রেলিয়ায় ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বিশেষ করে, বিংশ শতাব্দীতে বিপুল সংখ্যক পোলিশ, রাশিয়ান এবং জার্মান ইহুদি তাদের দেশ থেকে পালিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় নেয়। এই বিশাল অভিবাসনের কারণ ছিল ইউরোপে ইহুদিদের উপর বৈষম্য, নিপীড়ন এবং নাৎসি বাহিনীর নির্যাতন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ইহুদিরা মূলত সিডনি, মেলবোর্ন, এবং ব্রিসবেন শহরে বাস করে।

৮. রাশিয়া

বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম ইহুদি জনসংখ্যার দেশ রাশিয়া যেখানে প্রায় ১৪ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার জন ইহুদীদের বসবাস। রাশিয়াতে ইহুদিরা একটি ঐতিহাসিক জনগোষ্ঠী যারা ১০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশটিতে বসবাস করছে। বর্তমানে আধুনিক রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশে ইহুদি জনগোষ্ঠী বাস করে, যাদের উপস্থিতি ৭ম থেকে ১৪শ শতাব্দী থেকেই ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তবে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকাকালীন দেশটির ইহুদিরা ব্যাপক সামাজিক বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে দেশটিতে ইহুদিদের অবস্থার উন্নতির চেষ্টা করা হলেও ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়াতে ইহুদি বিদ্বেষের ঘটনা নতুন করে বৃদ্ধি পায়। ইহুদি বিদ্বেষের ঘটনা রাশিয়াতে আজও বিদ্যমান যার ফলে এখন পর্যন্ত অসংখ্য রাশিয়ান ইহুদি দেশ ত্যাগ করে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছে।

আরো জানুন: এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ১০টি দেশ

৭. আর্জেন্টিনা 

দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে অবস্থিত দেশ আর্জেন্টিনা যার সিংহভাগ জনসংখ্যাই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। তবে আর্জেন্টিনার প্রায় ৪ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১ লক্ষ ৮০ হাজার জন ইহুদি। আর্জেন্টিনায় বসতি স্থাপন করা প্রথম ইহুদিরা ছিল স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজ ইহুদি যারা ১৬ শতকে দেশটিতে এসেছিল। কিন্তু সেসময় দেশটিতে ইহুদিরা তেমন বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি। মূলত আর্জেন্টিনায় ইহুদিদের বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এসময় ফ্রান্স এবং পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক ইহুদি আর্জেন্টিনায় আসতে শুরু করে। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হলোকাস্ট থেকে পালিয়ে আসা ইহুদি শরণার্থীদের আর্জেন্টিনা আশ্রয় দিয়েছিল। বর্তমানে ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ইহুদি আর্জেন্টিনার বাসিন্দা যা বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ইহুদি জনসংখ্যার দেশ।

৬. যুক্তরাজ্য 

প্রায় ২ লক্ষ ৯২ হাজার ইহুদি জনসংখ্যা নিয়ে যুক্তরাজ্য বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ইহুদি জনসংখ্যার দেশ। যুক্তরাজ্যে ইহুদি বসতির প্রথম যেই লিখিত রেকর্ডটি পাওয়া যায় তা ছিল ১০৭০ সালের। কিন্তু তখনও ইহুদিরা যুক্তরাজ্যে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলতে পারেনি। কারণ ১২৯০ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হেনরি ইহুদিদের এই অঞ্চল থেকে বহিষ্কার করেন এবং পরবর্তী প্রায় ৪০০ বছর ইহুদিদের এই অঞ্চলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এরপর ১৯ শতকে যুক্তরাজ্যে ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। বিশেষ করে ২০ শতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রায় পাঁচ লাখ ইউরোপীয় ইহুদি নাৎসিদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে ইংল্যান্ডে পালিয়ে আসে, কিন্তু এদের মধ্যে মাত্র ৭০,০০০ জনকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের বেশিরভাগ ইহুদি ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে বাস করে। 

৫. কানাডা

উত্তর আমেরিকা মহাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইহুদি জনসংখ্যার দেশ হল কানাডা। দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি যেখানে ইহুদিদের সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ ৯৩ হাজার। কানাডায় ইহুদিদের আগমনের ইতিহাস ১৮ শতকের দিকে শুরু হয়। সেই সময় ইহুদিরা ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকায় অভিবাসন শুরু করে এবং তারা কানাডার বিভিন্ন শহরে বসতি স্থাপন করতে থাকে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে কানাডায় ইহুদি অভিবাসীদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে কানাডার অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে ইহুদিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি মুসলিম দেশ

৪. ওয়েস্ট ব্যাংক 

আধুনিক সময়ে ফিলিস্তিন দেশ দুইভাগে বিভক্ত। ওয়েস্ট ব্যাংক এবং গাজা স্ট্রিপ। এর মধ্যে ওয়েস্ট ব্যাংকের প্রায় পুরো জায়গা দখল করে আছে ইসরাইলের সরকার এবং মিলিটারি। ইসরাইল একটি ইহুদি রাষ্ট্র। আর তাই এই দেশ থেকে অনেক ইহুদিরা স্থায়ীভাবে ওয়েস্ট ব্যাংককে বসতি স্থাপন করেছে। ওয়েস্ট ব্যাংককে ইহুদিদের এই বসতি স্থাপনের ইতিহাস একটি জটিল ও বিতর্কিত ইতিহাস। বর্তমানে ওয়েস্ট ব্যাংককে ইহুদিদের সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষ ৩২ হাজার ৮০০ জন যা এই অঞ্চলকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ইহুদিদের অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। এই সকল ইহুদিরা ইসরাইলের নাগরিক এবং তারা ইসরাইলের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে।

৩. ফ্রান্স 

জনসংখ্যার দিক থেকে ফ্রান্স ইউরোপের বৃহত্তম ইহুদি দেশ যেখানে প্রায় ৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার জন ইহুদি। মধ্যযুগে ইহুদিদের জন্য ফ্রান্স ছিল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই অঞ্চলে ইহুদিদের ওপর নিপীড়নের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের প্রায় ২৫% ইহুদিদের নাৎসি বাহিনীর হলোকাস্টে হত্যা করা হয়। এরপরেও বর্তমানে ফ্রান্স বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ইহুদি জনসংখ্যার দেশ যার বেশিরভাগ প্যারিস শহরে বসবাস করে। 

২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর আমেরিকা মহাদেশের বৃহত্তম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইহুদি দেশ। দেশটির মোট জনসংখ্যা ৩৩ কোটির অধিক যার মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা প্রায় ৫৭ লক্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের আগমনের ইতিহাস ১৭ শতকের দিকে শুরু হয়। সেসময় এটি ছিল একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ। পরবর্তীতে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করার পর এই অঞ্চলে ইহুদিদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে শুরু করে। এছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল হলোকাস্ট থেকে পালিয়ে আসা ইহুদিদের জন্য একটি প্রধান আশ্রয়স্থল। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি সম্প্রদায়ের ৯০-৯৫% হল মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিদের বংশধর। 

আরো জানুন: এশিয়ার সবচেয়ে ছোট ১০টি দেশ

১. ইসরাইল 

প্রায় ৬৮ লক্ষ ৯৪ হাজার ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে গঠিত ইসরাইল বিশ্বের বৃহত্তম ইহুদি জনসংখ্যার দেশ। ইসরাইল বিশ্বের একমাত্র ইহুদি দেশ। এটি এমন একটি দেশ যার জন্মই হয়েছে ইহুদিদের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পর থেকে ইহুদিরা নিজেদের একটি আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা বোধ করতে থাকে, যেখানে তারা নিরাপদ এবং স্বাধীনভাবে বাস করতে পারবে। আর তাই নতুন দেশ গঠনের জন্য তারা ফিলিস্তিন অঞ্চলকে বেছে নেয় কেননা তারা বিশ্বাস করে যে তারা এই অঞ্চলের মূল অধিবাসী এবং এটি তাদের ঐতিহ্যবাহী ভূমি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে নিজেদের দেশ গঠন করে যার নাম দেওয়া হয় ইসরাইল। তবে ইসরাইল দেশ গঠন ইতিহাসের একটি বিতর্কিত অধ্যায়। বিশ্বের অনেক দেশই ইসরাইলকে একটি অবৈধ দেশ হিসেবে গণ্য করে। একইসাথে দেশ গঠনের পর থেকে ইসরাইলের মিলিটারির দ্বারা ফিলিস্তিনি মুসলমানদের হত্যা নির্যাতনের ঘটনা বারবার সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে এত সবকিছুর পরেও ইসরাইল এর শক্তিশালী মিলিটারি এবং সরকারের কারণে এখনও টিকে রয়েছে। 

এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।

ফেইসবুক পেইজ: The Earth Bangla

ইউটিউব চ্যানেল: The Earth Bangla

ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla

ফেইসবুক গ্রুপ: The Earth Bangla Family


Post a Comment

Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box

নবীনতর পূর্বতন